গেল
১০ নভেম্বর ১৯ বছর পেরিয়ে ২০তম বছরে পা দিয়েছে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট।
যে ভারতের বিপক্ষে সাদা পোশাকে নিজেদের প্রথম ম্যাচটি খেলেছিল বাংলাদেশ,
বিশের ঘরে ঢুকে কাকতালীয়ভাবে সেই দলটির বিপক্ষেই প্রথম ম্যাচটি খেলছে তারা।
কিন্তু এই সংস্করণে তারুণ্যের জয়গান গাওয়ার বদলে বাংলাদেশ এখনও পড়ে আছে
সেই শৈশবেই- হাঁটি হাঁটি পা পা যুগে! ইন্দোর টেস্টের দিকে তাকালেই যার
প্রমাণ মেলে। পাঁচ দিনের ম্যাচে তিন দিনের মধ্যে ইনিংস ব্যবধানে হার যে
আবারও চোখ রাঙাচ্ছে বাংলাদেশকে।
২০০০ সাল।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ঐতিহাসিক অভিষেক টেস্ট ম্যাচ। বাংলাদেশের
প্রতিপক্ষ ভারত। প্রথম তিন দিন লড়াই হলো সেয়ানে সেয়ানে। চতুর্থ দিনে
পাল্টে গেল চিত্র। অভিজ্ঞতা আর শক্তিতে এগিয়ে থাকা ভারতের বিপক্ষে দ্বিতীয়
ইনিংসে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ গুটিয়ে গেল মাত্র ৯১ রানে। জয়ের জন্য
পাওয়া ৬৪ রানের সহজ লক্ষ্যটা হেসেখেলে ১ উইকেট হারিয়ে পেরিয়ে গেল
ভারতীয়রা। সেই নাটকীয় ছন্দপতনের নজির থেকে এই ১৯ বছরে কতটা এগিয়েছে
বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট? সে প্রশ্নের উত্তর ‘ইতিবাচক’ না হয়ে যে
‘নেতিবাচক’ দিকেই এগোয়, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে?
চোখ মেলা
যাক পরিসংখ্যানের দিকে। ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের পর আরও ১১৪টি ম্যাচ
খেলে শেষ করেছে বাংলাদেশ (চলমান ইন্দোর টেস্ট বাদে)। এর মধ্যে জয় মাত্র
১৩টি, ড্র ১৬টি, বাকি ৮৬ টেস্টেই নিতে হয়েছে হারের তেতো স্বাদ। জয় পাওয়া
ম্যাচের প্রায় অর্ধেক (৬টি) দুর্বল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, ৪টি ওয়েস্ট
ইন্ডিজের বিপক্ষে। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় আছে
একটি করে।
বাংলাদেশ
বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জেতার স্বাদ নেয় ২০০৯ সালে। দুই ম্যাচের
সিরিজে ক্যারিবিয়ানদের ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করেছিল তারা। তবে সেই দলে
উইন্ডিজের মূল দলের তারকারা ছিলেন না। বাংলাদেশ পেয়েছিল আনকোরা
প্রতিপক্ষকে।
২০১৬ সালে
শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে হারানোর পরের বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও সাদা পোশাকে
জয়ের অমৃত স্বাদ নেয় বাংলাদেশ। দুটি জয়ই ছিল দেশের মাটিতে। টেস্ট অঙ্গনে
বাংলাদেশের সেরা সময়টা কাটে গেল বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে। ঘরের মাটিতে
পূর্ণশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে তারা। ঢাকার
মিরপুরের শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় টেস্টের জয়টা ছিল ইনিংস ও
১৮৪ রানের, কোনো প্রতিপক্ষকে ইনিংস ব্যবধানে হারানোর এটাই এখন পর্যন্ত
প্রথম ও একমাত্র নজির বাংলাদেশের।
তবে
স্মৃতিচারণের মতো এমন মধুর উপলক্ষ কমই পেয়েছে বাংলাদেশ। এই যেমন- ৮৬ হারের
৪০টিই ইনিংস ব্যবধানে! আর আফগানিস্তানের বিপক্ষে সবশেষ টেস্ট ম্যাচটি তো এক
অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়। মাত্র তৃতীয় টেস্ট খেলতে নামা আফগানদের বিপক্ষে
নিজেদের মাটিতে বৃষ্টিবিঘ্নিত টেস্টে ২২৪ রানের হার টেস্ট ক্রিকেটে
বাংলাদেশের কঙ্কালসার চেহারা আরও একবার ফুটিয়ে তোলে।
বাংলাদেশের
১১৫ টেস্ট ম্যাচের প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৭টি) শেষ হয়েছে তৃতীয় দিনে! এর
মধ্যে ২৩টিতেই হার দেখেছে তারা, ৪টি ফল আনতে পেরেছে নিজেদের দিকে। গেল বছর
উইন্ডিজের বিপক্ষে ২টি ম্যাচে নাস্তানাবুদ করা, তার আগে ২০১৬ সালে ইংলিশদের
বিপক্ষে স্মরণীয় জয় আর ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়েকে হারানো- সবই তিন দিনের
মধ্যে।
ব্যাটিং-বোলিং
দুই ক্ষেত্রেই টেস্টে বাংলাদেশের দিশাহীন অবস্থা। কোন উইকেট থেকে বাংলাদেশ
সুবিধা আদায় করে নিতে পারে- সে প্রশ্নের উত্তর এখনও জানা নেই যেন! কদিন
আগে দেশে আফগানিস্তানের বিপক্ষে অতি টার্নিং উইকেট বানিয়ে চরম হতাশা জাগানো
এক হারের মুখে পড়েছিল দল, রিস্ট স্পিনারের বিপক্ষে খেলতে না পারার
সামর্থ্য বেরিয়ে এসেছিল। অতীতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গতি ও বাউন্সে খাবি
খাওয়ার চিত্রও দেখা গেছে। আবার স্পোর্টিং উইকেটে (ইন্দোরের হল্কার
স্টেডিয়ামের উইকেটের মতো) মুভমেন্ট, গতি আর কৌশলী আক্রমণের বিপক্ষেও হাওয়া
বদলের কোনো ইঙ্গিত নেই।
সবচেয়ে বড়
যে প্রশ্নটা থেকে যায়, তা হলো- প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট তুলে নেওয়ার ক্ষমতা কি
বাংলাদেশের বোলারদের আছে? টেস্টের পেসার নিয়ে হাহাকারও তো আছে! এই
ফরম্যাটে উইকেট শিকারের সংখ্যায় বাংলাদেশের শীর্ষ পাঁচ বোলারের একজন বাদে
সবাই স্পিনার। সেই পেসারও আবার ২০০৯ সালের পর গেল ১০ বছরে কোনো টেস্ট ম্যাচ
খেলেননি- মাশরাফি বিন মর্তুজা। আর শীর্ষ পাঁচের কারোরই গড় ৩০ এর নিচে নয়।
এতেই বোঝা যায় দৈন্য!
১৯ বছর আগে
যে মানসিকতা নিয়ে টেস্ট খেলতে নামত বাংলাদেশ, তার পরিবর্তন আদৌ কি হয়েছে?
জেতার প্রত্যাশা তো দূরে থাক, ব্যাকফুটে থেকেই নামে দল। ব্যাটিং বিভাগ
শক্তিশালী করে সম্মানজনক স্কোর দাঁড় করানোর পরিকল্পনা থেকে অনেক সময়ই ছেঁটে
ফেলা হয় বোলারদের। আট-নয়জন ব্যাটসম্যান নিয়ে একাদশ সাজানোর উদাহরণ আছে
অনেক (ইন্দোরে যেমন পেসবান্ধব উইকেটে একজন পেসার কম নিয়ে একাদশ সাজিয়ে
খেসারত দিয়েছে দল)।
প্রশ্ন
উঠেছে বাংলাদেশের সাদা পোশাকে খেলার মানসিকতা নিয়ে। অথচ পাল্টে যাওয়ার
উদাহরণ রয়েছে কাছেই। এই শতাব্দির শুরুতে যখন বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পায়,
তখন কেবল কন্ডিশনের সুবিধা নিয়ে যে ভারত ঘরের মাটিতে কঠিন প্রতিপক্ষ ছিল,
তারা গেল ১৯ বছরে মানসিকতা বদলে-পরিকল্পনা সাজিয়ে দ্রুতলয়ে এগিয়ে এখন ঘরের
বাইরেও থাবা বসায়। চলতি বছরের শুরুতে যেমন উপমহাদেশের প্রথম দল হিসেবে তারা
টেস্ট সিরিজ জিতেছে ৩-১ ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। কেবল স্পিন আক্রমণে
নয়, পেসেও তারা বিশ্বের সেরাদের কাতারেও। দক্ষিণ আফ্রিকাকে সবশেষ তিন
ম্যাচের টেস্ট সিরিজে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়েছে তাদের গতি তারকারা।
বিপরীতে,
প্রায় দুই যুগ হয়ে গেলেও বাংলাদেশের ঘরোয়া পর্যায়ে ক্রিকেটের মানও সেই আগের
মতোই। নেই সুস্পষ্ট পরিকল্পনার ছাপ। স্বল্পমেয়াদে সাফল্য পাওয়ার নেশায়
আগামীর পথ চলা নিয়ে বাংলাদেশের নেই কোনো ভাবনা। আর এসব কারণেই একটুখানি
বিরূপ পরিস্থিতি এলেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে সব।
Star
No comments:
Post a Comment